Tuesday, November 10, 2020

স্ফুলিংগ ২য় বর্ষ, ১৯ তম সংখ্যা

 

                 

                              ।।   কথামুুখ ।। 


করোনাকাল আমাদের  জীবনের চেনা ছককে বেমালুম পাল্টে দিয়েছে। শুরু হয়েছে 'নিউ নর্মাল' যাপন। 

অদৃশ্য ভাইরাস যখন সবকিছুকে থামিয়ে দিয়েছিল, তখন কিন্তু সাহিত্যিকরা থেমে থাকেননি। চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও ব্যস্ত ছিলেন সময়টাকে অনুভব করতে। যার ছায়া পড়ছে তাঁদের রচনায়।

তবে এক জায়গায় থেমে থাকা যায় না। সাহিত্যও থামে না। অতিমারির মধ্যেই পুজো এলো। চলেও গেলো। 

স্ফুলিঙ্গ আবার হাজির। এবারে বিশেষ সংখ্যা নিয়ে। থাকছে গল্প, কবিতা, গদ্য কবিতা ।  আশা করি ভাল  লাগবে আপনাদের।


ক  বি  তা



রাখী সরদার


জাগরণ


হাতের পাঁচ আঙুলে

টোকা মেরে দেখো 

            অন্ধকার কটিবাঁকে

             আকাশ জেগেছে কিনা।


দেখো,আকাশ জাগাটা

ভীষণ জরুরি।


ওই ছদ্ম খরায়

ধান্য-দুধ ফেটে লাল,

           নদী ও লোহিত রাগে

            কাদায় রেখেছে মাথা

থেমেছে ঢেউয়ের কোলাহল ।


তুমি কি ঘুমিয়ে  গেলে?

খড়কুটো আনন্দে!


জাগো,দামাল বাতাস,

 মেঘ ভাঙে ব্যাকুল ফোঁটায়,            

                   ভেসেছে তোমার নেত্রকোণ ,

                   আর্দ্র রূপে  সমস্ত আকাশ।




 
             
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য


স্নান


অপ্রাপ্ত সাঁতারের কৌতূহলে কিছুদিন আগে নেমেছিল সর্পশূন্য দিঘি

বিকেলের মাথায় সেই দিঘিতে স্নান করে বাড়ি ফিরে শীতের মাটিতে শুয়ে পড়ে জলে বাঁধা কথার সিঁদুর 

ঠুনকো নীল ধ্বনি তখন এসে বসে আবেগের কাজল গার্হস্থ্য আশ্রমে

কিছুই যে নেই তার ভেতর 

শীতের মত দুঃস্থ উজ্জ্বল বাঁশি
শুধু অস্তমিত  আঘাতের স্বপ্নগুণের নিরাপদ দাগে
প্রদক্ষিণ করে নামের স্পর্শ মুখর আয়ুর আঁচিল।





রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ 


কৌশল 

বারান্দায় প্রলাপ 
আর শীতের জন্ম শিরায়

গভীর বিষন্নতা

বন্ধ্যা  ক্ষেতে ছড়িয়ে
মুঠো মুঠো ব্যর্থতা






বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য


অনিন্দ্য শরৎ

নীলাম্বরী শুভ্র কাশের 
কেশর দোলায় 
প্রত্যাশিত আলোয় খোঁজে নেই 
সুখের হোমাগ্নি 

মাঠে প্রান্তরে আলিঙ্গন করে আশ্বিনী রোদ।

সারাক্ষণ...
সবুজ চোখে কুয়াশার অঞ্জনে 
বেজে ওঠে
নবচেতনার শঙ্খধ্বনি 
এক শিরোনামহীন 
ভালোবাসায়।



শৈলেন দাস 


জল-আত্মা


জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ আমার শৈশব-সুবাস
জলের কলকল ধ্বনি শব্দের মিঠাস।

ছেঁড়া পাল ডিঙ্গি নৌকা পদ্মপুরাণ
কৈশোর কেটেছে যেন জলে ভাসমান!

তারপর ছন্দপতন, বাঁচার তাগিদ
বাসস্থান, জীবনশৈলী, আত্মতত্ত্ব বদল বিবিধ...


এখন শহুরে সভ্যতায় মিশে আছি বহুকাল
ইট কংক্রিটের পরিবেশে অভ্যস্ত জীবন, তবুও
জলের সাথে যোগ রয়েছে আমার আত্মার।




দেবাশিস সায়ন 


আশ্বিন


মা বলাটা কি সহজ তাই না?
দশ মাস দশ দিনের জঠর যন্ত্রণার কথা ভুলে গেলি?
দুর্গা পূজা বৃদ্ধাশ্রমে করবি?
মেয়ে শব্দটার অর্থ শুধু সহবাস?
অঞ্জলি মাতৃজঠরে হোক মৃত্তিকায় নয়!



                  গ  দ্য  ক  বি  তা



রূপরাজ ভট্টাচার্য 


বাজি


আজ একটি আকস্মিক পরীক্ষা হলো বন্ধু ! আজ সকল কথাই উপচার হয়ে সেজে উঠেছিল ধীর লয়ে ; তবু পুজো সারা হলো না কিছুতেই ! নির্মাল্য তাই বহতা স্রোতেই ভাসিয়ে দিলুম ! 

যে কথাগুলো অমলিন আর অভ্রান্ত সত্য ভেবে তুলে রেখেছিলাম দেরাজের গোপন খাঁজে , সে যে ফাঁকি ছিলো কে জানতো । আজ বিস্রস্ত বিবেকের সামনে পরীক্ষা হলো বন্ধু ; হ্যাঁ, বড়োই অকস্মাৎ ।

তুমি একেবারেই তৈরি ছিলে না ; নয়তো পুরোনো কথার মৌতাতে জ্বালিয়ে রাখতে সোপান, যেভাবে অভ্যস্ত হাতে নিয়ত সাজাতে পিলসুজ ! ... ''অনেক যাতনার পরও অবিন্যস্ত অবিচল থাকবে সময়'' -- এই গালভরা  কথাটাকেই প্রতিষ্ঠা দিতে সদা তৎপর থাকতে হয়তো । কিন্তু বড় ভুল হলো বন্ধু, বড় ভুল করে ফেললে ! 

আজকের পরীক্ষায় তোমাকে জিতিয়ে দিতে চেয়েছিলাম বারবার ; তবু জেতা বাজি বুঝি হেরে বসে আছি দু'জনেই ! আজ এই আকস্মিক পরীক্ষায় 'হেরো হেরো' বলে চিৎকার করে উঠছে মেধা ও মনন ---- তবু বুঝতে পারছি না হার-টা আসলে কার হলো!






 
তীর্থংকর চক্রবর্তীর  চারটে কবিতা



ভালোবাসা : মন্দ্র-মধ্য-তারে


নীড় ভাঙা শোকের গোরস্থানে
হরফে হরফে
কেন রাত্রি উড়িয়ে দাও !

অক্ষর ভালোবাসা পেলে
শব্দ হয়ে ওঠে ।
দরবেশ-মেঘ
গির্জা হয়ে ওঠে প্রেমিকের ।
ভালোবাসা পাহাড় পেরোলে
তর্জমা করে দিও,
নামাজী সন্ধ্যার শা'জাহান হয়ে রবে ।
                  



পথ হারানোর প্রতিশ্রুতি


যে পাখি উড়ে গেছে বিশ্বস্ত খাঁচায়
সে কি কাফের হলো কবি !

খুঁজে দেখো,
ভীরু জলময়ূরী মেঘে,
ওরসা রাতের বন্ধ্যা খোয়াবনামায়,
কিচ্ছা-রোদের নামতা লেখা থামে,
খানিক অন্য নামে
বটের বৃদ্ধ হাতে-
পাখি রেখে গেছে তার ডানার অস্তভাগ,
না-ফেরার কোন‌ও জোরালো প্রতিশ্রুতি ।

পাখি তো জেনেছে,
বন্দির কোন‌ও ঠিকানা হয় না দেশে ।
তুমি কি জেনেছ ?
পৃথিবীর পথে বাউল চলেছে সুদূরকে ভালোবেসে

!
                              



শাহজাদী


বলার আগে বুঝতে যদি পারো
ঠোঁটের বাঁধে গোপন কথার ঢেউ-
ওই ডাগর চোখে আঁকতে যদি পারো
এই হৃদয়-খোঁড়া ভালোবাসার নদী-
বন্ধু হতে আপত্তি নেই আর ।
আপত্তি নেই
চেনা-জানা সর্বনাশে ওড়না হতে ।
আপত্তি নেই
অবিশ্বাসী লোডশেডিং এ ভরসা হতে ।
আপত্তি নেই
ইচ্ছে-স্রোতের আড়-ইশারায় নিষেধ মানার ।
আলাদিনের প্রদীপ যদি ঘষতে পারো-
দুপুর রোদে শহর ঢেকে সাজতে পারি,
সমাজ-ভীরু শাহজাদীর একলা পথের কেউ ।
                             



স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপুরী


একলা বাঁচার রসদ কী ভাই

বলতে পারো ?

অনেক লোকের ভিড়ে যে'জন

হয়নি আপন অন্য কারো !

শেকড় শুধু ছড়িয়ে গেছে

আঁকড়ে ধরার অবুঝ আশায়,

দূরের গায়ে কাছ ঘেঁষেনি

এক পৃথিবীর ভালোবাসায় ।

নিছক কোন‌ও গোত্র ছাড়া

আমরা হবো বন্ধু যেদিন,

অভিধানের শব্দ-মানুষ

মানুষ হয়ে উঠবে সেদিন ।

সুতোর বাঁধন, কাঁটা-ছেঁড়া

অন্ধ চোখের জারিজুরি,

ভাগের নীতি যাক ভাগাড়ে

সমাজই হোক স্বপ্নপুরী ।


---------------------------------------------------------

গ  ল্প



বিভ্রম  


শর্মিলী দেব কানুনগো 


দীপের জীবনের আজ এক অনাস্বাদিত আনন্দের দিন। আজ মিতা আসছে দীপের কাছে। দীপ  মানে দীপঙ্কর। সুদর্শন, সুচাকুরে। মিতা ওর গত মাসে বিয়ে করা বৌ। আজ শ্বশুরবাড়ি থেকে স্বামীর কর্মস্থলে নতুন সংসার পাততে আসছে।  ওর জন্যই বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছে দীপ। 


দূর থেকে দীপকে দেখে হাত নাড়ল মিতা। মনে অনাগত ভবিষ্যতের আনন্দ শিহরণ। দীপের হাত ধরে মিতা এসে দাঁড়াল ওদের নতুন ঠিকানায়। খুব সুন্দর বাড়ি। সামনে দুদিক খোলা বারান্দা।  এক ফালি সবুজ বাগান। এক ঝলকে পছন্দ হল। আবার একরাশ খুশি ভালোলাগা হয়ে ছড়িয়ে পড়লো মিতার শিরায় শিরায়। শরীরে প্রবাহিত হল সেটা, মনেও। আনন্দের অবগাহনে দিন কাটতে লাগলো। 


  কদিন পর অফিস ফেরত দীপ দেখল গেটের সামনে একজন দাঁড়িয়ে। অবিন্যস্ত আর অপ্রকৃতিস্থ। দু চোখে হাহাকার আর বেদনা। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে দীপের বাড়ির দিকে। দীপকে দেখেই  লোকটা সন্ত্রস্ত  হয়ে পালিয়ে গেল । পরের দিন আবার লোকটাকে একই ভাবে দেখল দীপ। আগ্রাসী দুচোখ কাকে যেন খুঁজছে। তারপর আর কি! পুরুষ দীপের মনে জাগল সেই চিরাচরিত চিন্তা। মিতা কে খুঁজছে কি? তবে কি মিতার পুরনো..? কায়দা করে রাতে খাবার টেবিলে জিজ্ঞেস করল মিতাকে।  গ্রামের সরল মনের মেয়ে মিতা বলল একজন ভালবাসা জানিয়েছিল, কিন্তু মিতার অনাগ্রহে ব্যাপারটা এগোতে পারে নি। 


রোজ লোকটা আসে। রোজ দীপ ওর চোখে হাহাকার দেখে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রভাবিত হয় দাম্পত্য জীবন। দীপের মনে হল মিতা মিথ্যে বলছে। মিতা নিশ্চয়ই  নিজের ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করেছে । তাই তো সে  আজও মিতাকে দেখতে আসে।  ধীরে ধীরে সন্দেহের কালো ছায়া দীপকে সম্পূর্ণ গ্রাস করল। সবুজ বাগানের লাল গোলাপগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। 


       মিতা চলে গেছে ওর বাবার বাড়ি একরাশ অভিমান নিয়ে। দীপের অনাদর আর অবজ্ঞা ওকে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। মিতা কিছুতেই বুঝতে পারল না কেন দীপ হঠাৎ এতো বদলে গেল। কেন যে এত অকারণ  সন্দেহ করত। এই আঘাত সহ্য করা মিতার জন্য সহজ ছিল না। আর দীপ! অসহ্য  এক উত্তাপে পুড়ে যেতে থাকল সে। 


আজ আবার লোকটাকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারল না দীপ। পালাবার আগেই ওকে ধরে ফেলল। বারবার জিগ্যেস করা সত্ত্বেও কিছু বলল না লোকটা। বাধ্য হয়ে হাত তুলল দীপ। মিতার উপর জমানো সমস্ত রাগ অভিযোগ উগরে দিল পাগল টার উপর। এতো মার খেয়ে শুধু বলল      " মা"। তারপর কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। 


 অনেক দিন হয়ে গেল আর আসে নি লোকটা। দীপ কিছুটা শান্তি পেয়েছে। কিন্তু মিতার এই প্রতারণা ওকে মনে মনে দগ্ধ করছে। ও যে নিজের চোখে দেখেছে লোকটার চোখ পরম আগ্রহে মিতাকে খুঁজছে। সে চোখে শুধু ভালবাসা ছিল। ছিল প্রিয়জনকে  একটি বার  দেখার  আকুলতা । 


 পরের দিন সকালে গেটের সামনে ভিড় দেখে এগুলো দীপ। পাগলটা মরে গেছে। পাশের বাড়ির একজন বললেন মরল তো সেই নিজের বাড়ির সামনে। জিজ্ঞেস করে দীপ জানল পাগলটা ওর ভাড়াবাড়ির মালিকের ছোট ভাই। দাদা পাগল ছোট ভাইকে বের করে দেয় বাড়ি থেকে। অসুস্থ মাকে একটু চোখের দেখা দেখতে ও আসত। জানত না দাদা বাড়িভাড়া দিয়ে এখান থেকে চলে গেছে। 


 এবার দীপের প্রায়শ্চিত্তের পালা। মিতাকে ফিরিয়ে আনল। কিন্তু এ মিতা অন্য কেউ। দীপের দেয়া আঘাতে আজ মিতা ভাষাহীন স্থবির। দীপকে চিনতেই পারল না। সারাদিন বারান্দায় বসে মিতা দীপের অপেক্ষা করে। সেই দীপকে খুঁজে যে বাসস্ট্যান্ডে মিতার অপেক্ষা করেছিল।




            



অলংকরণ - সুজয় দাম।