Sunday, September 27, 2020

স্ফুলিঙ্গ, ২য় বর্ষ, ১৮তম সংখ্যা

 

---------------------------------------------------

                কথামুখ

----------------------------------------------------

কোনও কোনও কবিতা পাঠকের মনের আর্কাইভে পাকাপাকি ভাবে জায়গা করে নেয়। জীবনের নানা  বাঁকে ফিরে আসে কবিতাটি। এমনই একটা রচনা নিয়ে এবার লিখলেন বিশিষ্ট কবি সুজিৎ দাস। 

এবারের সংখ্যায় মুক্ত গদ্য লিখলেন পৌলমী চক্রবর্তী।  

আপনাদের ভাল লাগবে আশা করি।


========================================




                      একটি কবিতার কাছে


                                  সুজিৎ দাস


বিশ্বরাজ, তুমি বলেছিলে, একান্ত ভাললাগা কোনও একটি কবিতা নিয়ে কিছু লেখার জন্য। আসলে কী জানো, কোনও কবিতা, কোনও ছোটগল্প এসব নিয়ে কিছু একটা লিখতে বসলেই চোখে ভেসে উঠে সাহিত্যজগতের প্রাতিষ্ঠানিক লেখক বা প্রাবন্ধিকদের রাশভারি ছবি। তাদের অধিকাংশের লেখার বৃহৎ পরিসর জুড়ে থাকে দেশ-বিদেশের নানান সাহিত্যতত্ত্ব আর বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে সুদীর্ঘ সব প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতিগুচ্ছ। লেখকের মৌলিক চিন্তাভাবনার চেয়ে প্রায়শই এইসব তত্ত্বকথা আর  উদ্ধৃতির অনাবশ্যক বাহুল্য আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের কাছে ভারবহ হয়ে উঠে। তত্ত্বকথা ও উদ্ধৃতির জটাজালে লেখকের নিজস্ব ভাবনাবিশ্বকে আমরা ছুঁতে পারি না, তাঁর মৌলিক ভাবনাটা যেন কোথায় হারিয়ে যায়।

তুমি যখন বললে, আমার পঠিত যে কোনও সময়ের কোনও একটি কবিতা নিয়ে আমার একান্ত অনুভূতি ও বোধের জায়গাটি ব্যক্ত করার জন্য, আমি ভীষণ সমস্যায় পড়ে গেলাম। কী লিখবো, কী ভাবে লিখবো? কোন ভাললাগা কবিতা নিয়ে লিখবো বা কার কবিতা নিয়ে লিখবো? সকল কবিতাপাঠকের মতো আমিও সময় পেলে কবিতাই বেশি পড়ি। আবহমান বৃহত্তর বাংলা কবিতার ভুবনে এরকম অসংখ্য কবির কবিতা ছড়িয়ে রয়েছে যে গুলোর মধ্যে বেশ কিছু কবিতা অনেকের মতো আমাকেও স্পর্শ করেছে আলোড়িত করেছে আকুল করেছে। কখনও বা পাঠক হিসেবে কোনও কবিতা সহসা চমকেও দিয়েছে।

এ মুহূর্তে আমি যে কবিতাটিকে আশ্রয় করেছি সেটি বাংলা কবিতার পংক্তিভুক্ত নয়। বাংলায় অনূদিত আধুনিক অসমিয়া সাহিত্যের একটি অনালোচিত উপেক্ষিত অসাধারণ একটি কবিতা----


                               পোস্টমর্টেম


( অন্ধ্রপ্রদেশের আদিলাবাদে কাঠের চোরাকারবারি ও পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নিহত হওয়া একজন আদিবাসী যুবক)


প্রথমে তাকে তিন টুকরো করা হলো


কণ্ঠ থেকে বের করে আনা হলো সঙ্গীত

দু'চোখ থেকে নদী


বুকটা আবার দু'ভাগ করা হ'লো


কলজে থেকে তুলে আনা হ'লো প্রেম

পাকস্থলী থেকে শস্য


এবার তার পা দু'টোও আলাদা করে রাখা হলো


হাত থেকে খুলে রাখা হ'লো শব্দ

বাহু থেকে সাহস


অবশেষে জামাটাও দু'ভাজ করা হলো


বোতাম থেকে মুছে দেওয়া হ'লো চুম্বন

পকেট থেকে বিশ্বাস


ভোরবেলা সংবাদপত্রে বেরোলো


সে আদিলাবাদের একজন নির্ভীক যুবক


      ( অসমিয়া থেকে অনুবাদ: সুভাষ কর্মকার)


আধুনিক অসমিয়া সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি সমীর তাঁতীর  এই কবিতাটি যখন আমি প্রথম পড়ি সেই ১৯৮৬ ইংরেজিতে, সত্যিকার অর্থে আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আমার মনে হয় এ ধরনের কবিতাও লেখা যায়! পাঠকের মেধা মননে চাবুকের মতো যেন আঘাত করে কবিতাটির এক একটি শব্দবন্ধ, এক একটি বাক্যবন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা,এতটা বছর পেরিয়ে যাবার পরও আজকের ভারতবর্ষে সামজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতেও কবিতাটি ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। কেউ হয়ত বলবেন 'রাজনৈতিক কবিতা' কেউ  বলবেন 'প্রতি কবিতা'। যে সংজ্ঞাতেই কবিতাটিকে বন্ধনিভুক্ত করুন না কেন কবি তাঁর সামগ্রিক বোধ দিয়ে তাঁর নিজস্ব বয়ানটিকে স্বতন্ত্রভাবে ব্যক্ত করতে পেরেছেন কি না সর্বোপরি কবিতা হয়ে উঠেছে কি না আর সেই কবিতা পাঠকের মেধা-মননে কোনও অমোঘ অভিঘাত সৃষ্টি করতে পেরেছে কিনা সেটাই হচ্ছে আসল কথা। আমার মনে হয় সমীর তাঁতীর 'পোস্টমর্টেম' কবিতাটি এদিক থেকে বিচার করলে নিঃসন্দেহে একটি অনন্য সাধারণ কবিতা। বিষয় ও শৈলীর দিক থেকেও কবিতাটি অনন্য।


বিশ্বরাজ, পংক্তি ধরে ধরে কবিতাটিকে নিয়ে কাঁটাছেড়া আমার মনে হয় অপরিমিতিবোধের পরিচায়ক একইসঙ্গে  পাঠকদের প্রতিও অসম্মান প্রদর্শন। তাই এ থেকে বিরত থাকলাম। কবিতাটি একটি ছোট ঘটনাকে নিয়ে লেখা। অন্ধ্রপ্রদেশের একটি সাহসী আদিবাসী যুবকের মরণপণ লড়াইয়ের কথা কবিতাটিতে বলা হয়েছে। যুবকটি সেই রাজ্যের আদিলাবাদ নামক একটি অঞ্চলে কাঠের চোরাকারবারি ও রাষ্ট্রের তথাকথিত রক্ষক পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে অসহায়ভাবে মৃত্যু বরণ  করে। এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর অনুষঙ্গে কবি সমীর তাঁতী আদিবাসী যুবকটির নিথর শরীরী কাটাছেঁড়াকে এক ভিন্ন মাত্রার ব্যঞ্জনায় তাঁর তীক্ষ্ণ কলম দিয়ে দৃশ্যায়িত করেন যা আমাদের চেতনায়   তীব্র আঘাত করে। কবিতাটি মনে হয় এখানেই সফল

  

কৃতজ্ঞতা : ইত্যাদি,কবিতাপত্র, নভেম্বর,  ১৯৮৬ 




              পৌলমী চক্রবর্তীর দুটো মুক্ত গদ্য        


                 লকডাউন দৃশ‍্যকল্প


 বাজার থেকে বহুদিন পর পাওয়া গেছে একখানা নধর মুরগি। আমি আর মা আলোচনায় রত, কীভাবে ওটাকে বেশ তরিবত করে রাঁধা যায়। একটানা নিরামিষ খেতে খেতে মুখ পড়ে গিয়েছিল। এদিকে একঘেয়ে সুরে কেউ একটা ডেকেই চলেছে তখন থেকে, 'মাসি, ও মাসি'। 'কোন্ বোনপো আবার দরজায় দাঁড়িয়ে কে জানে', আমি ফোঁড়ন কাটি। পাশের বাড়ির ঋতা বৌদি দেখি চাল দিচ্ছে বারো-তেরো বছরের ছেলেটিকে। 

পরনে শতচ্ছিন্ন একটা শার্ট, ট্রাউজার্স তিন-চার জায়গায় ফেটে গেছে, কাঁধে একটা বিবর্ণ ঝোলা, মুখ শুকনো, চোখের কোণে পিচুটি, চুল উশকোখুশকো। ছেলেটি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বৌদির সুডৌল হাতে ধরা চালের বাটির দিকে। একটু নাক টানে, বাঁ হাতের  উল্টো পিঠে নাকের সর্দি মুছে নেয়, এবার কাঁধের ঝোলাখানা মেলে ধরে। যতক্ষণ চাল বাটি থেকে ঝরে, তার শেষ দানাটুকুর পড়ে যাওয়াও সে একদৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখে। আমি জানালায় উঁকি দিয়ে দেখতে দেখতে প্রমাদ গুনি- উফ! এই তো এবার আমাদের বাড়ির পালা। এমনিতেই গতকাল রাতে আড্ডা দিয়ে আজ উঠতে দেরি হয়েছে। দেড়টা বাজতে চলল। আমার মাংস কষাতে দেরি হয়ে যাবে। প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে বাইরে যাই। ওই ছেলের আমার কাছে আর কী চাওয়ার থাকতে পারে! সে তো কারও খোঁজে আমার বাড়ি আসেনি। তার দরকার ছিল না আমাদের বাড়ির কারও কাছে কোনও দরকারে আসার। তবু আমি তাকে ঝামরে উঠি, 'কী হে? কী চাই এখানে?'

ছেলেটি আমার মারমুখো মূর্তি দেখে চমকে ওঠে। ভয়ে ভয়ে বলে, 'গত একসপ্তাহ ধরে কিছু খাইনি দিদি। ঘরে আমার একটা দানাও নেই।' এমন সময় ঘরের ভেতর থেকে শেফালি এসে জিজ্ঞেস করে, 'দিদি, মাংসে টক দই দেবে নাকি ভিনিগার?" আমার ভুরুতে বিরক্তির ভাঁজ বাড়ে। আমি শেফালিকে বলি, 'তুমি ভেতরে যাও। বলছি।' হঠাৎ একবার ছেলেটির মুখে চোখ পড়ে যায়। ইতিমধ্যে 'মাংস' শব্দটি ছেলেটির কানে গেছে। ছেলেটি জুলজুল চোখে একবার আমার, একবার শেফালির মুখের দিকে তাকায়। আমি অস্বস্তিতে পড়ি। এভাবে তাকিয়ে থাকলে কিছু না দিয়ে থাকা যায়!

 ঘরে ফিরে আসার পর মা বলেন, 'শুনেছি দেশভাগের পরে নাকি উদ্বাস্তুরা এভাবে দোরে দোরে দাঁড়িয়ে ভাতের ফেন চাইত। এই লকডাউনের ফলে দেশের এক বিশাল অংশের মানুষ প্রায় না খেয়ে দিন কাটাতে বাধ‍্য হচ্ছে। এখন হয়তো এভাবে প্রতিদিন আমরা দেখতে থাকব।' 

আমি বিরক্ত হয়ে বলি, 'রিলিফ তো প্রতিদিন দেওয়া হচ্ছে এখানে ওখানে। ফালতু আসে নাকি এরা কে জানে!'

শেফালি তখন কাঁচা মাংসের টুকরো জল থেকে চিপে চিপে গামলায় তুলে রাখছে। বাবা বললেন, 'দিয়ে দে দশ টাকা ছেলেটাকে।' আমি খুচরো নেই বলে শেফালির হাত দিয়ে বাইরে পাঁচ টাকা পাঠালাম। ততক্ষণে টক দই মাংস জারিত করতে শুরু করেছে।



                                  নৈশালাপ

'চলো আমরা অন‍্য কিছুর গল্প করি।' চারদিকে হানাহানি... শিশুর লাশ কবর থেকে খুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে সে অন‍্য ধর্মাবলম্বী বলে। 'তাতে কী! দেখো গাছে কেমন লাল বাগানবাহার ফুল ফুটেছে। 'দেখো হাজার হাজার অসহায় মজুররা না খেতে পেয়ে রওনা হয়েছে নিরুদ্দেশের পথে...'

'আহা ছাড়ো না ওসব! কেমন গভীর চোখ দুটো তোমার..চলো নিঃশেষে ডুব দিই একে অন‍্যের চোখে...'

'দেখো মাথার ওপর শুধু দাদাদের হাত ছিল না বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে উজ্জ্বল মেয়েটা আজ মুখে রঙ মেখে কনে দেখা আলোয় দাঁড়িয়ে। তার জন‍্যে খোলা নেই কোনও চাকরির দরজা, তার জন‍্যে অপেক্ষা করে নেই কোন জোড় পরা সুন্দর যুবক। সে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা হায়নার অপেক্ষায়। যারা তার বুক তার তলপেট খুঁড়ে খুঁড়ে খাবে। একটা অন্ধকার কালো রাত কেটে গেলে সে তার ঠোঁটের ধেবড়ে যাওয়া রং মুছতে মুছতে ভাববে, মায়ের ক‍্যান্সারের ওষুধটা কেনার টাকা কোনও ক্রমে জোগাড় হয়ে যাবে।'

'আহ! তুমি বড় বাজে বকো! স্বচ্ছ নাইটির ভেতর থেকে তোমার শরীর যেন কোনও বতিচেল্লির সৌন্দর্য। আলোটা নিভিয়ে দাও। আর অবান্তর কথা নয়।।'







অলংকরণ: কুহেলী দেব রায় ও সুজয় দাম।