Saturday, March 28, 2020

লক ডাউন, প্রকৃতির ডাক ও কিছু কথা

              


          লক ডাউন, প্রকৃতির ডাক ও কিছু  কথা
                 
                                  মেঘদূত সেন

কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস গেল মাস-কুড়ি দিন থেকে বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছে। দুই হাজার বিশ সালকে যেন বিষিয়ে তুলেছে। চিন দেশ থেকে তার যাত্রা শুরু তারপর প্রায় সমগ্র দেশে হু হু করে ছড়িয়ে পড়েছে । বর্তমানে ইতালি বা স্পেনের পরিস্থিতি ভয়াবহ । রোজ পাঁচ শতাধিক লোক এই কোরোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন । আমাদের দেশও এই ভাইরাস থেকে ত্রাণ পায় নি। বর্তমানে সম্পূর্ণ দেশ লক ডাউন । যাতে রোগ না ছড়ায় ।তবুও আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছয়শ থেকে বেশি । রোজ এই সংখ্যা বেড়েই চলছে । মৃত লোকের সংখ্যাও দুই অঙ্ক ছাড়িয়ে গেছে । আতঙ্কে কাটছে প্রতি মুহূর্ত । কি জানি হাত ঠিক ভাবে ধুয়ে ঘরে ঢুকলাম তো! ভাইরাস আমার হাতে বা মুখে লাগে নি তো ! গলায় ব্যথা করছে সর্বনাশ করোনায় আক্রান্ত হয়ে গেলাম নাকি ।
          এদিকে  প্রধানমন্ত্রী বলেছেন উদ্বেগ না করতে । সবাই মিলে লড়তে হবে ।  দেশে খাদ্য শস্য প্রচুর পরিণামে আছে । ভয় নেই । কিন্তু কে শুনে কার কথা । নুন থেকে চুন,  চাল থেকে ডাল সবকিছু বেশি  করে  মজুত রাখতে সবাই ব্যস্ত ।
               শহর -বন্দর সবকিছু নিঝুম। গোটাকয়েক মুদিখানা ও ঔষধের দোকান ছেড়ে দিলে সব কিছুই বন্ধ ।  ব্যস্ততম সড়কে দু-চারটে গোরু অবাধে চলা ফেরা করছে ।এক দু'জন সবজান্তা ব্যক্তি 'হামসে বড়া কোন হ্যায়'  বলে বেরিয়ে পড়লে পুলিশ তাদের ঠিক ভাবে শায়েস্তা করে ভিজে বেড়াল বানিয়ে বাড়িতে পাঠাচ্ছে । ওইদিকে বিজ্ঞানের ভগবান ডাক্তার তথা চিকিৎসাকর্মীরা নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন দেশকে করোনা মুক্ত করতে । মন্দির-মসজিদ-গির্জা সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাওয়া সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ফেবুতে একজন লিখেছেন "ঘুমোচ্ছেন ভগবান জেগে আছে বিজ্ঞান ।" একদমই তাই বিজ্ঞানের ভরসায় আমরা সবাই । আশা রাখি খুব তাড়াতাড়ি এই মরণব্যাধি থেকে বিশ্ব বেরিয়ে এসে আগের মতো জেগে উঠবে ।
            তবে এই লকডাউন আমাদের গৃহ বন্দি করে রাখলেও প্রকৃতিকে যেন মুক্ত করে দিয়েছে। শেষ কবে বসন্তে কোকিলের কুহু ডাক শুনেছিলাম ভুলে গেছি । এই লকডাউন আমাদের কোকিলের কুহুতান থেকে শুরু করে, ঘুম ভাঙানো কাকের ডাক, নিঝুম রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক  আরও কত পাখির  কূজন আমাদের শুনাচ্ছে । বসন্তের নিটোল হাওয়া বইছে । পুকুরের জলে লালচে সর জমে উঠেছে । বাতাসের সংগে সূর্য ও সেই সর যেন খেলা করছে। অপরূপ দৃশ্য ।
 কৃষ্ণচূড়া চারার নবজাতক পাতায়  রোজ সকালে গিয়ে দেখতাম ধুলো জমে আছে । এখন সকালে গিয়ে দেখি  কচি পাতা সবুজ-হলুদ রঙ ধরেছে । বাতাসে তার  কচি পাতা মনানন্দে  দুলছে । বিকেলের রক্তিম সূর্য পাহাড়ের আড়ালে একটু একটু করে হারিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট ছবি দেখা যাচ্ছে । আরো কত কী!
       তবে আমরা জানি এই সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী । লক ডাউন শেষ হতেই আমরা আবার লেগে পড়ব নিজেদের কাজে । বেজে উঠবে বাইকের হর্ন থেকে ষোলো চাকা লরির হর্ন  । বাতাসে মিশে যাবে কল কারখানার কালো ধোঁয়া ।
কোথাও যেন হারিয়ে যাবে প্রকৃতির এই  নিটোল মায়ময় সৌন্দর্য ।  আমরা হয়ে উঠবো প্রকৃতিকে ধ্বংস করা নিষ্ঠুর কসাই ।
        তবে দেশ করোনা মুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াক আমরা সবাই চাই । সুস্থ হয়ে উঠুক পরিবারের প্ৰতিজন । অভয়ে যেন সবাই চলতে পারি ভাইরাসের ভয়কে পেছনে ফেলে । তবে  ইচ্ছে হয়  প্রকৃতির এই  সৌন্দর্য যেন চিরস্থায়ী হয় । দেশ করোনা মুক্ত হোক কিন্তু হারিয়ে যেন না যায় পাখির ডাক, বিকেলের সূর্যাস্ত কিংবা কৃষ্ণচূড়ার কচি পাতার খেলা ।
হয়ত সবকিছুই সম্ভব । যদি আমরা মান ও হুঁশ সহযোগে চলতে পারি । আমরা যদি সকল ব্যস্ততা ছেড়ে গৃহবন্দি হতে পারি তবে কি প্রকৃতির রূপ বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না ? যাতে নির্মল পরিবেশে আমরা বা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠতে পারে । যে ভাইরাস খালি চোখে দেখা যায় না তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারছি তবে কি পারবো না পরিবেশ বাঁচিয়ে রাখতে ?
এখনই সময় ভেবে দেখার ।
এই কুড়ি একুশ দিন আমাদের হাতের মুঠোয় ।  আমরা কি পারি না সবাই মিলে নতুন করে শুরু করতে ? করোনা মুক্ত দেশের সংগে সংগে প্রদূষণ মুক্ত দেশ গড়ে তুলতে ? যাতে আমরা সুরে সুরে মিলিয়ে গাইবো "তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির ডাকে জেগে।" আর এই শব্দগুচ্ছ বাস্তবে ভেসে উঠবে। 





মেঘদূত  সেন
 সম্পাদক 'আহেলী' পত্রিকা, শিলচর।


অলংকরণ -- ইন্টারনেট