Wednesday, August 1, 2018

গল্প 
........



লড়াই

শর্মিলী দেব কানুনগো


কদিন থেকে প্রচন্ড অস্থির শ্যামল বাবু। কি যে হবে.. নাম সব ঠিক ঠাক থাকবে তো? আজ সকালে তড়িঘড়ি ছুটলেন সেবা কেন্দ্রে। নিজের চোখে ছবি সহ সবার নাম দেখে তবে স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। উফ যা গেল কদিন ধরে। ফেরার পথে হাতে  ইলিশ আর দৈ মিষ্টি নিয়ে বাড়ি এলেন। ভারতীয় হওয়ার আনন্দ উদযাপন। সিঁড়ি থেকে হাঁক দিলেন,
—ক ই গো কোথায় গেলে.. এদিকে এসে নিয়ে যাও এটা। আর জমিয়ে রান্না কর তো আজ...
  বৃদ্ধ বাবা একবার তাকালেন শ্যামলবাবুর দিকে। উচ্ছাসহীন ভাবে।  এসব বড্ড বিরক্ত লাগে শ্যামল বাবুর। এরা যে কি.. আনন্দ কে গ্রহণ করতে যেন অসুবিধা এদের। যাগগে.. ওসব ভেবে লাভ নেই। বরং আজ অনেকদিন পর শান্তিতে খাওয়া যাবে।
    আজ শ্যামল বাবুর বাবা বড্ড অশান্ত হয়ে আছেন। ফোনে খবরাখবর নিচ্ছেন সবার। খেতে বসে বললেন
—বৌমা আজ ইলিশ নামবে না গলা দিয়ে.. আমাকে আর দিও না। হাইলাকান্দির বিরাজের আর হাফিজ দের পরিবার বড় সংকটে। আমি কি করে ভুলি বৌমা... এক অন্ধকার রাতে যখন আমার গাঁয়ে দাঙ্গার আগুন জ্বলছিল, তখন  নামমাত্র দামে জমি জিরাত বিক্রি করতে হয় আসলাম  আলির  কাছে। রাতের অন্ধকারে নাবালক সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে এপারে পালিয়ে আসতে বাধ্য হই। কিন্তু ঐ রাতে আমাকে নদী  পেরোতে সাহায্য করে আসলাম এর পরিবারের লোকেরা। কই ওরা তো সেদিন ইলিশ খেয়ে নিজেদের আনন্দ কে উদযাপন করেনি। ওরা তো সেদিন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছিল আমার কাছে।  এপারে এসে অসহায় অবস্থায় আশ্রয় নিয়েছিলাম পিসতুতো ভাই  বিরাজদের বাড়িতে।যতদিন না কাজকর্ম পেলাম, ওরা ততদিন  হাসিমুখে আমার পরিবারের ভার বহন  করল। জায়গা জমি কিনে থিতু হতে সাহায্য  করল হাফিজ। সম্পর্কে  আসলাম এর পিসির ছেলে। কিন্তু ওরা কেন আমার জন্য এতকিছু করল বৌমা? এতে ওদের কি লাভ হল বল তো?
শ্যামল বাবু  অধোবদন। ইলিশ এর স্বাদ আচমকা চলে গেছে। বাবা বলে চলেছেন...
—বৌমা... জীবনের যখন সুযোগ পাবে নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করবে। এতে নিজের কাছে নিজের সম্মান বাড়বে। ছিন্নমূল দের একটাই জাত।প্রজন্মের পর প্রজন্ম ওরা একই পরিচয় বহন করে। ওদের শিকড়ে মাটির বন্ধন থাকে না। ওদের জীবন যেন জলজ উদ্ভিদের জীবন। তাই ওরা প্রশাখা দিয়ে একজন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচে। আর ঝড় ঝঞ্ঝা বান থেকে বাঁচতে হলে একে  অপরকে আঁকড়ে  ধরে বাঁচা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।কারণ আমরা কেউ জানি না জীবন কখন কাকে কোন দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে।
 
শ্যামল বাবু র গলা দিয়ে নামছে না আর ইলিশ মাছ। মনে পড়ছে সব পুরনো দিনের কথা। হাইলাকান্দির সেইসব প্রতিবেশী মানুষরা কেমন আছেন যারা আপদে বিপদে সব সময় পাশে ছিলেন বিশাল ছায়া দেওয়া  গাছের মত।  কি করে আজ তিনি সব ভুলে গেলেন। বড় লজ্জা করল তার। এতটা অমানুষ  তিনি হতে পারবেন না। এই অস্তিত্বের সংকটময় দিনে এদের পাশে না  দাঁড়ালে যে তিনি  ঋণগ্রস্ত থেকে যাবেন আজীবন। মুখে বললেন,

—কাল আমি একবার  হাইলাকান্দির পুরনো বাড়িতে যাব। কদিন ছুটি নিয়ে ওদের পাশে থাকি  গিয়ে । যতটুকু পারি সাহায্য করব ওদের এই সংকটে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন এর বিবেকহীন কাজ কর্ম  আর অমানবিক স্বার্থপরতার  শিকার  হচ্ছে এক বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী।  এদের পাশে আমি দাঁড়াব বাবা। বাবা বাঁহাতে চোখটা মুছলেন।
 
আজ বাড়ির বেড়ালটার যে কি হলো.. ইলিশ মাছ ছুঁয়ে ও দেখল না।


..........
কবিতা
.........



যাযাবর সন্তান


ভাস্কর জ্যোতি (আলোর জীবাশ্ম)



সদ্যোজাত এক শিশু,
অগ্নি থেকে নৈঋত, নৈঋত থেকে ঈশানে ছুটে যায়।
সে যাযাবর।
সে ঈশ্বর।

নিষাদের অন্তিম অস্ত্র হারিয়ে গেলে,
হলুদ সূর্য লক্ষ্য করা ছুটে চলে,
আরো এক নতুন পৃথিবীর সন্ধানে।
কিন্তু তবুও সে জাতিস্মর।

ভাঙা ছাইয়ের সঙ্গে মিশে গেছে,
হাজার পল্টন প্রহরী।
ভূমিপুত্র রব তোলে।
সোঁদা গন্ধকে আপন করে,
মানুষের সমাধি গড়েছে তাতে।

ভাঙা পাতিলের এক রাশ শব্দের মাঝে,
জোরে চিৎকার দেয় সে শিশু
 "আমি উদ্বাস্তু নই,
আমি যাযাবর,
আমিই ঈশ্বর"


ছবি-ইন্টারনেট



লেখা পাঠান- sfulinga.2007@gmaol.com