খো লা ক ল ম
.....................
এনআরসি আর কিছু প্রশ্নচিহ্ন
সোমাভা বিশ্বাস
-আইজও অত দেরি করলায়, রুজ রুজ কিতা শুরু করসো সীমা?
-মাসি, এনআরসিত নাম উটসে না আমার আর ননদের, কইসলাম নু আইজ আইতে দেরি অইব,আমরার বস্তিত যারার নাম উটসে না সবে আইজ মিটিং কররা, নাম না উটলে ইন্ডিয়াত থাকতে দিত নায় কইরা হকলে...
-শুন, ইতা আন্দু মাত মাতিও নায়, জেবায় যাওয়ার যাও, আমার ঘরো কামে আওয়ার টাইম ঠিক রাখতে লাগব। তুমার নাম উটসে না, ননদের নাম উটসে না, ইতা আমারে শুনাইয়ো নায় আইয়া...
ক্রিং ক্রিং...ফোনের আওয়াজে গৃহকর্ত্রী থমকান,কাজের মেয়ে সীমাকে ছেড়ে মোবাইলে মনোযোগ তার,
-হ্যা বাবাই বল, গত সপ্তাহে ফোন করলি না কেন?শরীর ভাল আছে তো? নিউ জার্সির ওয়েদার কেমন? বরফ পড়ছে নাকি? আগের দিন বলছিলি খুব ঠাণ্ডা...
-উফ মা, অত কথার উত্তর দেওয়ার মত সময় এখন আমার নেই, তুমি বাপীকে বোলো এনআরসির লিস্টে আমাদের নাম উঠেছে লিখে যে ওয়াটস্যাপ মেসেজ করেছিল, দেখেছি। রিপ্লাই করার টাইম পাইনি।
-ওহো, আচ্ছা। অফিসে খুব কাজের চাপ চলছে বুঝি?
-না না, অফিস তো এখন ছুটি। আমরা নিউ ইয়ার সেলিব্রেট করতে ভেগাস এসছি লাস্ট উইক। আচ্ছা শোনো, আমার, রিয়ার আর টুবাইয়ের নামের বানানে ভুল আছে কিনা চেক করতে বোলো তো বাপীকে। আমাদের স্কুল ফ্রেন্ডসের গ্রুপে দেখলাম অনেকে লিখেছে তাদের নামের বানানে ভুল আছে।
-না না তোদের তিনজনের নামের বানান তো ঠিকই আছে, তোর বাপী বলছিল। আচ্ছা, তোরা এবার ভেগাস গেলি কেন রে? ছুটি পেলি যখন, বাড়ি এলেই তো পারতি, টুবাইটাকে কত বছর দেখিনি...
-আরে, এখন ইউএস ছেড়ে বেরবো কি করে?বাপীকে বললাম তো লাস্ট মান্থে এখানে গ্রিন কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি, তোমাকে বলেনি বাপী?
-ওহ, গ্রিন কার্ড! নাহ না... আমায় তো কিছু বলেনি তোর বাপী। গ্রিন কার্ড...মানে তোরা ও দেশেই সেটেল করবি...আর ফিরবি না...
-উফফ শোনো মা, এত সেন্টিমেনটাল হয়ও না তো। দেশে কী আছে, কিসের জন্যে ফিরব এত ভাল কেরিয়ার প্রসপেক্টস ছেড়ে, এত সুযোগ সুবিধে ছেড়ে...বলতে পার? হ্যাঁ? কি বললে?নিজের দেশ তো নিজের দেশই? ওসব ব্যাকডেটেড কথাবার্তা কেন বলছ বলত! দেশে ফিরলেও তো সেই ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ নয়তো মুম্বাইয়ে থাকতে হবে। তোমাদের সঙ্গে বাড়িতে তো আর থাকছি না। আসামের কি অবস্থা! ওখানে মানুষ বাস করে কী করে কে জানে...চাকরির কোনো স্কোপ নেই, বাচ্চার পড়াশুনার ভাল স্কুল নেই,সেফটি সিকিওরিটি, বেসিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার কিচ্ছু ঠিক নেই। কাগজে তো সবই পড়, তবু দেশে ফেরার কথা বলছ? বরং তোমরা এখানে এসে থেকে যাও কটা মাস। নেক্সট ইয়ার প্ল্যান কর। সব ঠিক করে জানিও, টিকিট কেটে দেব আমি...ঠিক আছে?শোনো, পরে কথা বলব, এখন ফোন রাখছি। তুমি কিন্তু মনে করে বাপীকে বোলো এনআরসির লিস্টে আমাদের নামের স্পেলিং গুলো ডাবল চেক করে নেয় যেন...
***
এনআরসি নিয়ে লিখতে বলায়, একটু থমকে গেছিলাম। কী লিখব? নাগরিকপঞ্জি হওয়াটা নিশ্চয়ই দরকার কিন্তু আর সকলের মতন আমার মনেও যে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন রয়েছে। ওপরের কথোপকথনটিতে আমার মনের অনেক প্রশ্নের মধ্যে মাত্র একটি তুলে ধরেছি। কিন্তু এছাড়াও আরও কতই প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খায়- এত জন মানুষের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করে রয়েছে? কেন আসামের বাঙালি এবং অন্যান্য কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নচিহ্নহের মুখে? জাতীয় নাগরিকপঞ্জির প্রথম খসড়ায় পাহাড়প্রমাণ ভুলের কারণ কী? এত জনের নাম (যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না) অনুপস্থিত কেন? কখনো গোটা পরিবারের নাম বাদ, তো কোথাও সন্তানের নাম রয়েছে, বাবা-মায়ের নাম অনুপস্থিত- লিগ্যাসি ডাটা দাখিল করার অর্থ কী তবে? অনুপ্রবেশকারী কারা,তা নির্ণয় করার জন্যে আসামের ভৌগলিক কাঁটাচেরার ইতিহাস সঠিকভাবে জানা উচিৎ নয় কি? ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে মানুষকে লাঞ্ছনা,অত্যাচার করা কেন? যাদের নাম নাগরিকপঞ্জীর প্রথম খসড়ায় নেই তাদের অনেককে এনআরসি কেন্দ্রগুলিতে ডেকে নিয়ে নানান হেনস্থা করা হয়েছে, এর কারণ কী? দেশের মাটিতে পা দিতে ইচ্ছুক নন এমন প্রবাসীদের নাম নাগরিকপঞ্জিতে উঠে যায় অনায়াসে, কিন্তু আজন্ম দেশে থাকা সেই সব খেটে খাওয়া মানুষের, বিশেষ করে যারা শিক্ষার আলোয় আসার সুযোগ পাননি, অর্থকষ্টের মধ্যে রয়েছেন যারা, তাদের মনের মধ্যে যে চূড়ান্ত আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, নিত্যদিন জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি এনআরসি কে ঘিরে যে অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তার মধ্যে তারা রয়েছেন-তাদের স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার কী হবে? নাকি ‘স্ট্রেস’ নামক ব্যাধিটা নিম্নবিত্তদের হয় না? এনআরসিকে ঘিরে বাক স্বাধীনতা খর্ব করা হবে কেন? উনিশের ভাষাশহীদদের সন্তান আমাদের প্রজন্মের অনেকের এনআরসি নিয়ে একটু ভাবারও সময় নেই। নাকি ইচ্ছে নেই? জানিনা ঠিক। আমরা অনেকে মনে করি, ওসব আমাদের চেয়ে যারা বয়সে বড়, জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ, তাদের মাথা ঘামানোর ব্যাপার। আচ্ছা, ১৯৬১তে কমলা দাসের বয়স কত ছিল? তিনি বা তাঁর নবীন সাথীরা যদি পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিঃস্পৃহ থাকতেন তাহলে কী হত?
প্রশ্নগুলো আরও অনেকের মতই আমাকেও ভাবিয়ে তোলে। আসাম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, লন্ডনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও এসব প্রশ্ন মনে ঘোরাফেরা করে। কখনো চমকে উঠে ভাবি, স্যার ক্যাম্পবেল, লর্ড কার্জন, স্যার র্যাডক্লিফ, লর্ড মাউন্টব্যাটন- দেশকে কেটে চিরে ভাগ করার ইতিহাসের সঙ্গে এইসব ইংরেজ নামগুলোই জড়িত নয় কি? আমার এখনকার আবাস ইংল্যান্ডের মাটিতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছেন এরা। আর তাদের অমর কীর্তি সেই দেশ ভাগের জের আজও অশান্ত করে রেখেছে আমার জন্মভূমিকে।
সাম্প্রদায়িকতার, ভেদাভেদের বিষ বৃক্ষটি রোপণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার ৭০ বছর পরও আমরা ভালো নেই, কেন?যাদের ওপর আমাদের ভালো রাখার দায় বর্তায়,তারা কেন আমাদের সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান করতে অপারগ? আমাদের মনে রাখতে হবে,অসমীয়া মানেই ‘বাঙালি খেদা’ নয়। ‘বাঙ্গাল’মানেই জেহাদি নয়। কিন্তু ব্রিটিশ মুক্ত ভারতে বারে বারে দেখা গেছে, রাজনীতি (সে যে রঙ, যে চিহ্নই বহন করুক) মানেই বিভাজন। রাজনৈতিক দল গুলির ছায়ায় পরিপুষ্ট ধর্মীয় সংগঠন মানেই দ্বেষ,দ্বন্দ্ব। ৬০ এর দশকের রাউরকেলা, রাঁচি,জামশেদপুরের সংঘর্ষ, ৭০ এর ভিওয়াদি দাঙ্গা, ৮০ র মোরাদাবাদ, বিহারশরিফের মৃত্যুমিছিল,আসামের নেলি হত্যাযজ্ঞ, ৮৪ এর উত্তাল দিল্লী,বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক বিতর্ক ও সঙ্ঘাত, ৯০ এর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের তীব্র সঙ্ঘাত, ২০০২ এর গুজরাত রায়ট...রাজনীতির ছায়া সবখানে।রাজনীতির একটি প্রধান লক্ষ্য জনকল্যাণ। কিন্তু রাজনৈতিক দল, নেতারা যদি বিভিন্ন জাতের,ভাষার, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করত, তাহলে আসামে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হত কি? অবশ্য ভাববার কথা এটাও, ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতে বিভাজন-মুখি রাজনীতির জন্য দায়ী কী?
সেই কবে, ১৯৬০ এর দশকে সাংবাদিক সেলিগ হ্যারিসন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ভারতে ভাষা সংঘর্ষের জন্যে আগামীতে অপেক্ষা করে রয়েছে ভয়ঙ্কর কিছু দশক। তাঁর ভবিষ্যৎবাণী নির্ভুল হওয়াটা ঠেকানো কি অসম্ভব?
আসলে, প্রশ্ন করা যতটা সহজ, উত্তর পাওয়া ততটাই কঠিন।
দাঙ্গা, সংঘর্ষের সময় অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির যোগ দেখা গেছে। সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু আশার কথা,দাঙ্গা, অসহিষ্ণুতা পেরিয়ে জাতি, ধর্ম, ভাষার বেড়াজাল পেরিয়ে, পরস্পরকে শ্রদ্ধা করে সম্প্রীতিকে ফিরিয়ে আনতে সাধারণ মানুষই সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন বারে বারে।
***
(এই প্রবন্ধের লেখিকা প্রবাসী। তবে নিজের মাতৃভূমিতে প্রবল ভাবে ফিরতে চাওয়া এক প্রবাসী। মানুষের মনুষ্যত্বের ওপর যার অটল বিশ্বাস। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর বিত্ত বৈভবে যে মজতে পারে নি। মা, বাবা, ছোট ভাই- পরিবারের সকলের নাম এনআরসির প্রথম খসড়ায় থাকলেও কেবল তার নামটিই কোন দুর্বোধ্য কারণে বাদ পড়ে গেছে। এত অনিশ্চয়তা, এত প্রশ্নের ঝড়ের মধ্যেও স্বপ্নরা জায়গা করে নেয় কোন জাদুবলে।বৈধ নাগরিক হিসেবে তার জন্মভূমিতে শিগগিরি পা রাখার স্বপ্ন সে দেখে চলেছে।)
####
.............
কবিতা
.............
সময়
দেবাশিস সায়ন
জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের আবেদন রাখতে গিয়ে পৃথিবীটা দেশ নামক কাঁটাতারে বিভক্ত।
তবুও, সময়ে সময়ে উন্মোচিত হয় নিষ্পেষিতের হাহাকার।
কেন?
শান্তি, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও ভালবাসার বাড়তি বৈ কমতি নেই এখানে।
কিন্তু, বৃহৎ মঞ্চে রাজনৈতিক নাটিকার কুশীলবরা থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে।
কেন?
আমজনতা এই "কেন" এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কালের বীভৎসতা পেছনে ফেলে স্বজনের লাশ মাড়িয়ে হয় দেশান্তরী।
ছবি-ইন্টারনেট
sfulinga.2007@gmail.com
.....................
এনআরসি আর কিছু প্রশ্নচিহ্ন
সোমাভা বিশ্বাস
-আইজও অত দেরি করলায়, রুজ রুজ কিতা শুরু করসো সীমা?
-মাসি, এনআরসিত নাম উটসে না আমার আর ননদের, কইসলাম নু আইজ আইতে দেরি অইব,আমরার বস্তিত যারার নাম উটসে না সবে আইজ মিটিং কররা, নাম না উটলে ইন্ডিয়াত থাকতে দিত নায় কইরা হকলে...
-শুন, ইতা আন্দু মাত মাতিও নায়, জেবায় যাওয়ার যাও, আমার ঘরো কামে আওয়ার টাইম ঠিক রাখতে লাগব। তুমার নাম উটসে না, ননদের নাম উটসে না, ইতা আমারে শুনাইয়ো নায় আইয়া...
ক্রিং ক্রিং...ফোনের আওয়াজে গৃহকর্ত্রী থমকান,কাজের মেয়ে সীমাকে ছেড়ে মোবাইলে মনোযোগ তার,
-হ্যা বাবাই বল, গত সপ্তাহে ফোন করলি না কেন?শরীর ভাল আছে তো? নিউ জার্সির ওয়েদার কেমন? বরফ পড়ছে নাকি? আগের দিন বলছিলি খুব ঠাণ্ডা...
-উফ মা, অত কথার উত্তর দেওয়ার মত সময় এখন আমার নেই, তুমি বাপীকে বোলো এনআরসির লিস্টে আমাদের নাম উঠেছে লিখে যে ওয়াটস্যাপ মেসেজ করেছিল, দেখেছি। রিপ্লাই করার টাইম পাইনি।
-ওহো, আচ্ছা। অফিসে খুব কাজের চাপ চলছে বুঝি?
-না না, অফিস তো এখন ছুটি। আমরা নিউ ইয়ার সেলিব্রেট করতে ভেগাস এসছি লাস্ট উইক। আচ্ছা শোনো, আমার, রিয়ার আর টুবাইয়ের নামের বানানে ভুল আছে কিনা চেক করতে বোলো তো বাপীকে। আমাদের স্কুল ফ্রেন্ডসের গ্রুপে দেখলাম অনেকে লিখেছে তাদের নামের বানানে ভুল আছে।
-না না তোদের তিনজনের নামের বানান তো ঠিকই আছে, তোর বাপী বলছিল। আচ্ছা, তোরা এবার ভেগাস গেলি কেন রে? ছুটি পেলি যখন, বাড়ি এলেই তো পারতি, টুবাইটাকে কত বছর দেখিনি...
-আরে, এখন ইউএস ছেড়ে বেরবো কি করে?বাপীকে বললাম তো লাস্ট মান্থে এখানে গ্রিন কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করেছি, তোমাকে বলেনি বাপী?
-ওহ, গ্রিন কার্ড! নাহ না... আমায় তো কিছু বলেনি তোর বাপী। গ্রিন কার্ড...মানে তোরা ও দেশেই সেটেল করবি...আর ফিরবি না...
-উফফ শোনো মা, এত সেন্টিমেনটাল হয়ও না তো। দেশে কী আছে, কিসের জন্যে ফিরব এত ভাল কেরিয়ার প্রসপেক্টস ছেড়ে, এত সুযোগ সুবিধে ছেড়ে...বলতে পার? হ্যাঁ? কি বললে?নিজের দেশ তো নিজের দেশই? ওসব ব্যাকডেটেড কথাবার্তা কেন বলছ বলত! দেশে ফিরলেও তো সেই ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ নয়তো মুম্বাইয়ে থাকতে হবে। তোমাদের সঙ্গে বাড়িতে তো আর থাকছি না। আসামের কি অবস্থা! ওখানে মানুষ বাস করে কী করে কে জানে...চাকরির কোনো স্কোপ নেই, বাচ্চার পড়াশুনার ভাল স্কুল নেই,সেফটি সিকিওরিটি, বেসিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার কিচ্ছু ঠিক নেই। কাগজে তো সবই পড়, তবু দেশে ফেরার কথা বলছ? বরং তোমরা এখানে এসে থেকে যাও কটা মাস। নেক্সট ইয়ার প্ল্যান কর। সব ঠিক করে জানিও, টিকিট কেটে দেব আমি...ঠিক আছে?শোনো, পরে কথা বলব, এখন ফোন রাখছি। তুমি কিন্তু মনে করে বাপীকে বোলো এনআরসির লিস্টে আমাদের নামের স্পেলিং গুলো ডাবল চেক করে নেয় যেন...
***
এনআরসি নিয়ে লিখতে বলায়, একটু থমকে গেছিলাম। কী লিখব? নাগরিকপঞ্জি হওয়াটা নিশ্চয়ই দরকার কিন্তু আর সকলের মতন আমার মনেও যে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি নিয়ে কতগুলো প্রশ্ন রয়েছে। ওপরের কথোপকথনটিতে আমার মনের অনেক প্রশ্নের মধ্যে মাত্র একটি তুলে ধরেছি। কিন্তু এছাড়াও আরও কতই প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খায়- এত জন মানুষের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করে রয়েছে? কেন আসামের বাঙালি এবং অন্যান্য কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষের নাগরিকত্ব প্রশ্নচিহ্নহের মুখে? জাতীয় নাগরিকপঞ্জির প্রথম খসড়ায় পাহাড়প্রমাণ ভুলের কারণ কী? এত জনের নাম (যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না) অনুপস্থিত কেন? কখনো গোটা পরিবারের নাম বাদ, তো কোথাও সন্তানের নাম রয়েছে, বাবা-মায়ের নাম অনুপস্থিত- লিগ্যাসি ডাটা দাখিল করার অর্থ কী তবে? অনুপ্রবেশকারী কারা,তা নির্ণয় করার জন্যে আসামের ভৌগলিক কাঁটাচেরার ইতিহাস সঠিকভাবে জানা উচিৎ নয় কি? ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে মানুষকে লাঞ্ছনা,অত্যাচার করা কেন? যাদের নাম নাগরিকপঞ্জীর প্রথম খসড়ায় নেই তাদের অনেককে এনআরসি কেন্দ্রগুলিতে ডেকে নিয়ে নানান হেনস্থা করা হয়েছে, এর কারণ কী? দেশের মাটিতে পা দিতে ইচ্ছুক নন এমন প্রবাসীদের নাম নাগরিকপঞ্জিতে উঠে যায় অনায়াসে, কিন্তু আজন্ম দেশে থাকা সেই সব খেটে খাওয়া মানুষের, বিশেষ করে যারা শিক্ষার আলোয় আসার সুযোগ পাননি, অর্থকষ্টের মধ্যে রয়েছেন যারা, তাদের মনের মধ্যে যে চূড়ান্ত আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, নিত্যদিন জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি এনআরসি কে ঘিরে যে অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তার মধ্যে তারা রয়েছেন-তাদের স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, তার কী হবে? নাকি ‘স্ট্রেস’ নামক ব্যাধিটা নিম্নবিত্তদের হয় না? এনআরসিকে ঘিরে বাক স্বাধীনতা খর্ব করা হবে কেন? উনিশের ভাষাশহীদদের সন্তান আমাদের প্রজন্মের অনেকের এনআরসি নিয়ে একটু ভাবারও সময় নেই। নাকি ইচ্ছে নেই? জানিনা ঠিক। আমরা অনেকে মনে করি, ওসব আমাদের চেয়ে যারা বয়সে বড়, জ্ঞানে, অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ, তাদের মাথা ঘামানোর ব্যাপার। আচ্ছা, ১৯৬১তে কমলা দাসের বয়স কত ছিল? তিনি বা তাঁর নবীন সাথীরা যদি পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে নিঃস্পৃহ থাকতেন তাহলে কী হত?
প্রশ্নগুলো আরও অনেকের মতই আমাকেও ভাবিয়ে তোলে। আসাম থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, লন্ডনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও এসব প্রশ্ন মনে ঘোরাফেরা করে। কখনো চমকে উঠে ভাবি, স্যার ক্যাম্পবেল, লর্ড কার্জন, স্যার র্যাডক্লিফ, লর্ড মাউন্টব্যাটন- দেশকে কেটে চিরে ভাগ করার ইতিহাসের সঙ্গে এইসব ইংরেজ নামগুলোই জড়িত নয় কি? আমার এখনকার আবাস ইংল্যান্ডের মাটিতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছেন এরা। আর তাদের অমর কীর্তি সেই দেশ ভাগের জের আজও অশান্ত করে রেখেছে আমার জন্মভূমিকে।
সাম্প্রদায়িকতার, ভেদাভেদের বিষ বৃক্ষটি রোপণ করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার ৭০ বছর পরও আমরা ভালো নেই, কেন?যাদের ওপর আমাদের ভালো রাখার দায় বর্তায়,তারা কেন আমাদের সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান করতে অপারগ? আমাদের মনে রাখতে হবে,অসমীয়া মানেই ‘বাঙালি খেদা’ নয়। ‘বাঙ্গাল’মানেই জেহাদি নয়। কিন্তু ব্রিটিশ মুক্ত ভারতে বারে বারে দেখা গেছে, রাজনীতি (সে যে রঙ, যে চিহ্নই বহন করুক) মানেই বিভাজন। রাজনৈতিক দল গুলির ছায়ায় পরিপুষ্ট ধর্মীয় সংগঠন মানেই দ্বেষ,দ্বন্দ্ব। ৬০ এর দশকের রাউরকেলা, রাঁচি,জামশেদপুরের সংঘর্ষ, ৭০ এর ভিওয়াদি দাঙ্গা, ৮০ র মোরাদাবাদ, বিহারশরিফের মৃত্যুমিছিল,আসামের নেলি হত্যাযজ্ঞ, ৮৪ এর উত্তাল দিল্লী,বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক বিতর্ক ও সঙ্ঘাত, ৯০ এর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরের তীব্র সঙ্ঘাত, ২০০২ এর গুজরাত রায়ট...রাজনীতির ছায়া সবখানে।রাজনীতির একটি প্রধান লক্ষ্য জনকল্যাণ। কিন্তু রাজনৈতিক দল, নেতারা যদি বিভিন্ন জাতের,ভাষার, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করত, তাহলে আসামে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হত কি? অবশ্য ভাববার কথা এটাও, ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতে বিভাজন-মুখি রাজনীতির জন্য দায়ী কী?
সেই কবে, ১৯৬০ এর দশকে সাংবাদিক সেলিগ হ্যারিসন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ভারতে ভাষা সংঘর্ষের জন্যে আগামীতে অপেক্ষা করে রয়েছে ভয়ঙ্কর কিছু দশক। তাঁর ভবিষ্যৎবাণী নির্ভুল হওয়াটা ঠেকানো কি অসম্ভব?
আসলে, প্রশ্ন করা যতটা সহজ, উত্তর পাওয়া ততটাই কঠিন।
দাঙ্গা, সংঘর্ষের সময় অনেক ক্ষেত্রেই রাজনীতির যোগ দেখা গেছে। সব ক্ষেত্রেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু আশার কথা,দাঙ্গা, অসহিষ্ণুতা পেরিয়ে জাতি, ধর্ম, ভাষার বেড়াজাল পেরিয়ে, পরস্পরকে শ্রদ্ধা করে সম্প্রীতিকে ফিরিয়ে আনতে সাধারণ মানুষই সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন বারে বারে।
***
(এই প্রবন্ধের লেখিকা প্রবাসী। তবে নিজের মাতৃভূমিতে প্রবল ভাবে ফিরতে চাওয়া এক প্রবাসী। মানুষের মনুষ্যত্বের ওপর যার অটল বিশ্বাস। প্রথম বিশ্বের দেশগুলোর বিত্ত বৈভবে যে মজতে পারে নি। মা, বাবা, ছোট ভাই- পরিবারের সকলের নাম এনআরসির প্রথম খসড়ায় থাকলেও কেবল তার নামটিই কোন দুর্বোধ্য কারণে বাদ পড়ে গেছে। এত অনিশ্চয়তা, এত প্রশ্নের ঝড়ের মধ্যেও স্বপ্নরা জায়গা করে নেয় কোন জাদুবলে।বৈধ নাগরিক হিসেবে তার জন্মভূমিতে শিগগিরি পা রাখার স্বপ্ন সে দেখে চলেছে।)
####
.............
কবিতা
.............
সময়
দেবাশিস সায়ন
জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের আবেদন রাখতে গিয়ে পৃথিবীটা দেশ নামক কাঁটাতারে বিভক্ত।
তবুও, সময়ে সময়ে উন্মোচিত হয় নিষ্পেষিতের হাহাকার।
কেন?
শান্তি, ঐক্য, সৌহার্দ্য ও ভালবাসার বাড়তি বৈ কমতি নেই এখানে।
কিন্তু, বৃহৎ মঞ্চে রাজনৈতিক নাটিকার কুশীলবরা থাকে লোকচক্ষুর আড়ালে।
কেন?
আমজনতা এই "কেন" এর উত্তর খুঁজতে খুঁজতে কালের বীভৎসতা পেছনে ফেলে স্বজনের লাশ মাড়িয়ে হয় দেশান্তরী।
ছবি-ইন্টারনেট
sfulinga.2007@gmail.com