কবিতা যদি হয় যাপনের সঙ্গী, তাহলে রোজনামচার সব বিষয় অনায়াসে ধরা দিতে পারে কবিতায়। থিমের ভারে ভারাক্রান্ত না করে নির্বাচিত কবিদের কাছে অনুরোধ ছিল, এই দগ্ধ দিনগুলোকে আপনারা কী ভাবে অনুভব করছেন, তা নিয়ে লিখুন।
কবি যে কোনও পরিস্থিতিতেই কবিতার আতসকাচ দিয়ে চারপাশকে দেখার চেষ্টা করেন। কবি তো সত্যদ্রষ্টা! 'রোম যখন পুড়ছিল তখন নিরো বেহালা বাজাচ্ছিলেন', এই প্রাচীন উক্তি বহুশ্রুত। তবে সেই আগুনে বা বেহালার সুরে পাপ ছিল না পুণ্য? এই প্রশ্ন এক মাত্র কবি-ই জিজ্ঞেস করতে পারেন!
পারদ চড়ছে। সূর্য গনগনে আঁচ ছড়াচ্ছে। তাই এই উষ্ণ সময়কে নিয়ে কবিদের কাব্য-অনুভবে সাজানো হলো এ বিশেষ সংখ্যা।
তাপ নিয়ন্ত্রণে সিগারেট জ্বালাই
দেবপ্রতিম দেব
আজ কাকভোরে একটা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল -
গত প্রেমিকার কাছে ব্রাত্য হয়েছি - এই স্মৃতি , সেই পতন অভিমানে
আগলে রেখেছি নিজেকে , এই পৃথিবীতে যেমন আকাশ-পাখি ,
নদী-জল কাছে নেই গ্রীষ্মে গাছের অভাবে ;
এমন উষ্ণতার দিনে এখন
নাগরিক জীবন আমার প্রাক্তনের মত খুঁজে ফিরে আশ্রয়ের ছায়া ;
আর আমি এই গ্রীষ্মদুপুর বারোটায় বর্তমান প্রেমিকার গালের ঘামজলে
রক্ত-আভা দেখে তাপ নিয়ন্ত্রণে সিগারেট জ্বালাই ,
ঠিক যেমন নাগরিকরা তাদের আত্মঘাতী কামাতুর স্বভাবে
ট্রাফিকে ধোঁয়া ছড়ায় এমন উষ্ণদিনে-ও ।
অবসর
শর্মি দে
উষ্ণদিনের অবসরে
গোপন থাকুক ব্যথারা
অর্কিডের কান্নাবাসা
ঝুলবারান্দায় থাক ধরা!
রবিবারের সকালে
মুক্তির উচ্ছ্বাস
চিনামাটির ভালবাসারা
জানান দিচ্ছে ইশারায়!
মেঘলা আকাশ জানে
মেঘের আকাশ ছোঁয়া বাকি
পদ্যের মেঘ তোমায় ঘিরে
ফিনিক্স হয়ে আসে ফিরে-ফিরে!
পেরিয়ে যাওয়া দিনগুলো
পরিচয়ে আসে যায়
সময়ের সংলাপ ফিরে আসে
শূন্যতার কাঠগড়ায়!
উদ্বিগ্ন প্রহরে
কল্পিতা দেব
ফ্ল্যাট বাড়িতে ড্রয়িংরুমে সাজে মানিপ্ল্যান্ট
কিংবা ওই দেখা যায় বনসাই;
বটগাছ উপড়ে ফেলে যখন
ফ্ল্যাটটি নির্মিত হয়,
সেখান থেকেই বাঁচিয়ে
এক গাছ-প্রেমিক তা
তৈরি করে সাজিয়েছিলেন।
তারা খুবই যত্নে আছে
ঠান্ডা হওয়া ঘরে
কাচের শোপিসে।
তখনই
উষ্ণতার এই বুক ভাঙা শহরে
জলন্ত বাতাসে
হাজার-হাজার গাছের
ম্রিয়মান ফুসফুস
একটু জল খোঁজে
কালস্রোতের বিদীর্ণ দর্পণে।
দহন
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য
উষ্ণ ফাটল রোদের ডালে পাখির বিপুল তৃষ্ণা...বুকভরা
এখানে ক্লান্ত দহন তলায় পিষ্ট হাওয়ার শরীর
বৃষ্টিহীন শুষ্ক দিনের খালি গা।
তবু বিপন্নতার ছোটগল্প স্বার্থপর অস্থির
সভ্যতার কৃত্রিম সঙ্কটে থমকানো কঠিন ।
মানুষ নামের জমিতে
কাটা গাছের গন্ধ ,কাটা পাহাড়ের গন্ধ, কাটা জলের গন্ধ...
আমাদের রচিত জানালার পারে
একাকী মানবজীবনের নিঃসঙ্গ ঝরাপালক।
নীল জোছনার রাতে
সোমা মজুমদার
নীল জোছনার রাত, জোনাকিদের যাপন সুখের উপাখ্যান লিখছে রাত হাওয়ারা।
জলের আয়নায় চাঁদের অহমিকা।
দুপুরের তপ্ত রোদ ডানায় মেখে একটা পাখি মেঘের চিঠি রেখে যেতো সন্ধ্যার পাশে।
আমি কতদিন কোনও চিঠি লিখি না।
পৃথিবীর এদিকটা নাকি হেলে আছে সূর্যের দিকে।
তাই মেঘের কিংবা উত্তুরে হাওয়ার চিঠি নিয়ে শ্রাবণের পাখিটা এখন আর আসছে না।
তবুও আজকের রাতটা যেন রাতপরীর ডানা থেকে খসে পড়া নীল জোছনার হিল্লোলে প্লাবিত...
ইচ্ছে হয় এমন রাতের জোছনা মাড়িয়ে হেঁটে যাই নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে।
সেই রূপকথার দেশে, যেখানে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর গাছের নিচে তলোয়ার পাশে রেখে নির্বাসিত রাজপুত্র একাই ঘুমিয়ে পড়ে।
পৃথিবী এবার মেঘের দিকে হেলে আসুক, তারপর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামুক।
আমি কতদিন পর আবার একটা চিঠি লিখবো শ্রাবণ পাখিটার জন্য।
অলঙ্করণ- ইন্টারনেট।