প্রগল্ ভ সময়ে ''বাঙালির গান''
........................................
তূর্য চক্রবর্তী
"...গান তুমি হও
জীবন বিমুখ গানের সমকালে
বাঁচার লড়াই বাঁচাও আমায়
তোমার তালে তালে..."
--- কবীর সুমন
এই মুহূর্তে অসমের বাঙালির মরণ- বাঁচন দশা। কালবেলায় দাঁড়িয়ে গান অন্ততপক্ষে এ রাজ্যে নিছক বিনোদনের মাধ্যম হতে পারে না।
"বাঙালির গান" কথাটি শোনা মাত্র অনেকের কপালে ভাঁজ পড়তে পারে। তৈরি হতে পারে বিতর্কের ক্ষেত্র। বর্তমানে অগ্নি-পরীক্ষার মুখোমুখি বাঙালির একান্ত নিজস্ব বেঁচে থাকার গান থাকবে না, এ কথা কেউ আশা করি বুক ঠুকে বলতে পারবে না ( শুধু উগ্রজাতীয়তাবাদী ছাড়া)।
গান বরাবরই মানুষের কথা বলে । সোজা কথায়, গান লড়াইয়ের অক্সিজেন জোগায়। হেমাঙগ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীরাতো গান দিয়ে মানুষের মনের বন্ধ দরজায় কড়া নেড়েছিলেন।
বরাকে এই মুহূর্তে যে গান-বাজনা হচ্ছে,তা এখনও বিনোদনের পর্যায়ে আছে বলে মনে হয়। কারণ, গান হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সময়ের গান কই?
যে গানে বিপন্ন মানুষের কথা থাকবে। থাকবে শেকড়ের ঘ্রাণ। আতংকের কালো লোমশ হাতকে কেটে ফেলার কথা চিৎকার করে বলবে যে গান। না, এই গান এখনও তৈরি হয়নি।
অসমীয়ারা অন-অসমীয়াদের থেকে এগিয়ে থাকার কথা উঁচু গলায় বলেন। আর এই কথাটা তাঁরা বলেন কিন্তু সংস্কৃতির ওপর জোর দিয়ে । প্রতিবার বিহুর সময় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মঞ্চে মঞ্চে খুব গান হয়। যেগুলো তাঁদের নিজস্ব কম্পোজিশন। সেখানকার স্থানীয় শিল্পীরা এ সব গানকে মাথায় তুলে রাখেন।
কিন্তু বরাকে স্থানীয় গানগুলো মার খাচ্ছে। মঞ্চে এগুলো গাওয়ার রিস্ক নিতে চান না স্থানীয় শিল্পীরা। ফলে নিজেদের গান দিয়ে প্রতিপক্ষের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়াটা হচ্ছে না। স্থানীয় সুরকার-গীতিকাররাও উৎসাহ হারাচ্ছেন।
বাংলা গানের মনে হয় এতটুকু ক্ষমতা আছে যে যারা বাঙালিকে পদানত করতে চায় তাদেরকে মুখ আর মুখোশের পার্থক্যটা বুঝিয়ে দিতে পারবে। এই বিপন্ন সময়ে নিজেদের গান লড়াইয়ের অন্যতম মাধ্যম অতি অবশ্যই হতে পারে। তবে কোন গান গাওয়া হবে বা তৈরি করা হবে, সেটা শিল্পীদের সবচেয়ে আগে ঠিক করতে হবে।
চিরবন্ধু রবীন্দ্রনাথ । তাঁর গানকে এই দুর্দিনে অাঁকড়েতো ধরতেই হবে। তবে বরাক বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিকে নিজস্ব রবীন্দ্রনাথ আগে তৈরি করতে হবে। যাতে স্বভূমে বাঙালিকে পরবাসী করার ফন্দি যারা অাঁটছে তাদের জব্দ করা যায়।
কিন্তু যাঁরা রবীন্দ্রসংগীত করেন তাঁদেরও এখানে বড় একটা দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, অনেক সময় স্থান-কাল বিচার না করেই কিছু শিল্পী রবীন্দ্রসংগীত করেন। কয়েক বছর আগে শিলচরে যেমন বসন্ত উৎসবে এক শিল্পী গাইলেন "ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে''। বুঝুন!
শিল্পী সংগ্রামী হেমাঙগ বিশ্বাস তাঁর "রবীন্দ্রসংগীতের বিচার, বিশ্লেষণ ও ব্যবহার " প্রবন্ধে লিখছেন -- ''...এই সেদিন AITUC আয়োজিত বিরাট ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেসে গিয়ে দেখি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন, 'দিনের শেষে ঘুম দেশে...'। একবার কল্পনা করুন, শ্রমিক মেহনতি মানুষের বিরাট সমাবেশে এককালের প্রগতিবাদী, IPTA - এর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন এমন একটি গান, যার সাথে স্থান-কাল-পাত্রের কোনো সমপর্কই নেই!..."
আবার এর বিপরীতেও উদাহরণ আছে। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মুখে মুখে ফিরত রবি ঠাকুরের গান। ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নিওটো বধ্যভূমিতে যাবার আগে রবি ঠাকুরের গানই গেয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতে কী শক্তি আছে। অসমের বাঙালিকে এই শক্তিটা কাজে লাগাতে হবে।
আর কথা নয়। এবার জোট বেঁধে বেঁচে থাকার গান গাওয়ার পালা। তাই কী গান বাঙালি গাইবে তা বাঙালিকে ঠিক করতে হবে। গাইতে হবে সময়ের গান। আর তখনই ইটের বদলে পাটকেল ছোঁড়া যাবে কুচক্রীদের। তাদের চোখে অাঙুল দিয়ে দেখানো যাবে যে সত্যি-
"...আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়।"
##
।।কবিতা।।
গৃহতল
...........
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য
আছাড় খাচ্ছে মাটির গন্ধে আমাদের জন্ম আশ্রয়
পুরাতন গৃহের আয়োজন তেপান্তরের মাঠে উধাও পাখি।
জল মাখা বিণুনির সূর্যাস্ত ভেজা শব্দ
সন্ধ্যা
অবয়বশূন্য নদীমাতৃকা।
এই সব স্মৃতিকথার আবেগ জড়িয়ে ধরে
আমাদের গ্রাম শহরের ঠাণ্ডা বাতাস।
নিরিবিলি বৃষ্টি কুড়িয়ে রাখা মানুষের ছায়া
সুরক্ষিত মর্ম-মর্যাদা
রোদে রোদে ভ্রাতৃত্ব টানাপোড়েন
সন্তর্পণে পুড়িয়ে রাখে মিলনভূমির কান্না।
ছবি-ইন্টারনেট
সম্পাদক- বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য
im.biswaraj@gmail.com
........................................
তূর্য চক্রবর্তী
"...গান তুমি হও
জীবন বিমুখ গানের সমকালে
বাঁচার লড়াই বাঁচাও আমায়
তোমার তালে তালে..."
--- কবীর সুমন
এই মুহূর্তে অসমের বাঙালির মরণ- বাঁচন দশা। কালবেলায় দাঁড়িয়ে গান অন্ততপক্ষে এ রাজ্যে নিছক বিনোদনের মাধ্যম হতে পারে না।
"বাঙালির গান" কথাটি শোনা মাত্র অনেকের কপালে ভাঁজ পড়তে পারে। তৈরি হতে পারে বিতর্কের ক্ষেত্র। বর্তমানে অগ্নি-পরীক্ষার মুখোমুখি বাঙালির একান্ত নিজস্ব বেঁচে থাকার গান থাকবে না, এ কথা কেউ আশা করি বুক ঠুকে বলতে পারবে না ( শুধু উগ্রজাতীয়তাবাদী ছাড়া)।
গান বরাবরই মানুষের কথা বলে । সোজা কথায়, গান লড়াইয়ের অক্সিজেন জোগায়। হেমাঙগ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরীরাতো গান দিয়ে মানুষের মনের বন্ধ দরজায় কড়া নেড়েছিলেন।
বরাকে এই মুহূর্তে যে গান-বাজনা হচ্ছে,তা এখনও বিনোদনের পর্যায়ে আছে বলে মনে হয়। কারণ, গান হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সময়ের গান কই?
যে গানে বিপন্ন মানুষের কথা থাকবে। থাকবে শেকড়ের ঘ্রাণ। আতংকের কালো লোমশ হাতকে কেটে ফেলার কথা চিৎকার করে বলবে যে গান। না, এই গান এখনও তৈরি হয়নি।
অসমীয়ারা অন-অসমীয়াদের থেকে এগিয়ে থাকার কথা উঁচু গলায় বলেন। আর এই কথাটা তাঁরা বলেন কিন্তু সংস্কৃতির ওপর জোর দিয়ে । প্রতিবার বিহুর সময় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মঞ্চে মঞ্চে খুব গান হয়। যেগুলো তাঁদের নিজস্ব কম্পোজিশন। সেখানকার স্থানীয় শিল্পীরা এ সব গানকে মাথায় তুলে রাখেন।
কিন্তু বরাকে স্থানীয় গানগুলো মার খাচ্ছে। মঞ্চে এগুলো গাওয়ার রিস্ক নিতে চান না স্থানীয় শিল্পীরা। ফলে নিজেদের গান দিয়ে প্রতিপক্ষের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়াটা হচ্ছে না। স্থানীয় সুরকার-গীতিকাররাও উৎসাহ হারাচ্ছেন।
বাংলা গানের মনে হয় এতটুকু ক্ষমতা আছে যে যারা বাঙালিকে পদানত করতে চায় তাদেরকে মুখ আর মুখোশের পার্থক্যটা বুঝিয়ে দিতে পারবে। এই বিপন্ন সময়ে নিজেদের গান লড়াইয়ের অন্যতম মাধ্যম অতি অবশ্যই হতে পারে। তবে কোন গান গাওয়া হবে বা তৈরি করা হবে, সেটা শিল্পীদের সবচেয়ে আগে ঠিক করতে হবে।
চিরবন্ধু রবীন্দ্রনাথ । তাঁর গানকে এই দুর্দিনে অাঁকড়েতো ধরতেই হবে। তবে বরাক বা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিকে নিজস্ব রবীন্দ্রনাথ আগে তৈরি করতে হবে। যাতে স্বভূমে বাঙালিকে পরবাসী করার ফন্দি যারা অাঁটছে তাদের জব্দ করা যায়।
কিন্তু যাঁরা রবীন্দ্রসংগীত করেন তাঁদেরও এখানে বড় একটা দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, অনেক সময় স্থান-কাল বিচার না করেই কিছু শিল্পী রবীন্দ্রসংগীত করেন। কয়েক বছর আগে শিলচরে যেমন বসন্ত উৎসবে এক শিল্পী গাইলেন "ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে''। বুঝুন!
শিল্পী সংগ্রামী হেমাঙগ বিশ্বাস তাঁর "রবীন্দ্রসংগীতের বিচার, বিশ্লেষণ ও ব্যবহার " প্রবন্ধে লিখছেন -- ''...এই সেদিন AITUC আয়োজিত বিরাট ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেসে গিয়ে দেখি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন, 'দিনের শেষে ঘুম দেশে...'। একবার কল্পনা করুন, শ্রমিক মেহনতি মানুষের বিরাট সমাবেশে এককালের প্রগতিবাদী, IPTA - এর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইছেন এমন একটি গান, যার সাথে স্থান-কাল-পাত্রের কোনো সমপর্কই নেই!..."
আবার এর বিপরীতেও উদাহরণ আছে। অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মুখে মুখে ফিরত রবি ঠাকুরের গান। ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা নিওটো বধ্যভূমিতে যাবার আগে রবি ঠাকুরের গানই গেয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতে কী শক্তি আছে। অসমের বাঙালিকে এই শক্তিটা কাজে লাগাতে হবে।
আর কথা নয়। এবার জোট বেঁধে বেঁচে থাকার গান গাওয়ার পালা। তাই কী গান বাঙালি গাইবে তা বাঙালিকে ঠিক করতে হবে। গাইতে হবে সময়ের গান। আর তখনই ইটের বদলে পাটকেল ছোঁড়া যাবে কুচক্রীদের। তাদের চোখে অাঙুল দিয়ে দেখানো যাবে যে সত্যি-
"...আকাশ জুড়ে লেখা আমার আত্মপরিচয়।"
##
।।কবিতা।।
গৃহতল
...........
নীলাদ্রি ভট্টাচার্য
আছাড় খাচ্ছে মাটির গন্ধে আমাদের জন্ম আশ্রয়
পুরাতন গৃহের আয়োজন তেপান্তরের মাঠে উধাও পাখি।
জল মাখা বিণুনির সূর্যাস্ত ভেজা শব্দ
সন্ধ্যা
অবয়বশূন্য নদীমাতৃকা।
এই সব স্মৃতিকথার আবেগ জড়িয়ে ধরে
আমাদের গ্রাম শহরের ঠাণ্ডা বাতাস।
নিরিবিলি বৃষ্টি কুড়িয়ে রাখা মানুষের ছায়া
সুরক্ষিত মর্ম-মর্যাদা
রোদে রোদে ভ্রাতৃত্ব টানাপোড়েন
সন্তর্পণে পুড়িয়ে রাখে মিলনভূমির কান্না।
ছবি-ইন্টারনেট
সম্পাদক- বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য
im.biswaraj@gmail.com