।। পাঠ ভাবনা।।
'বারকোশ' ও একান্ত অনুভব
শর্মিলী দেব কানুনগো
আমার সদ্য পড়া বইটির নাম ‘বারকোশ’। কথাশিল্পী রূপরাজ ভট্টাচার্যের গল্প সংকলন।
শিরোনাম থেকেই ভালবাসায় পড়ে গেলাম বইটির। আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো বারকোশ শব্দটা শোনেনি। এই শব্দটার সঙ্গে আমারও কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে! এই নামেই একটা গল্প আছে লেখকের। তাই সংকলনের নাম সেই গল্পকে ছুঁয়ে রাখা হয়েছে। শুধু কী তাই! এই নাম যে আমার মতো স্মৃতিমেদুর পাঠকের মনে তরঙ্গ তুলে ছড়িয়ে গেল!
বইয়ের প্রচ্ছদের কথা বলি এবার। অত্যন্ত মনোগ্রাহী প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদ শিল্পী সুপ্তা ভট্টাচার্য। লেখককে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি বলে প্রচ্ছদ নিয়েও দুটো কথা বলছি। প্রচ্ছদের ছবি লেখকের মা সুপ্তা ভট্টাচার্যের নিজের হাতে করা কাগজের কোলাজ। এখানেও ছুঁয়ে আছে এক ফেলে আসা দিনের হৃদয়-গাথা। কোন সূদুর অতীতে কাগজ কেটে-কেটে সেটা জুড়ে মাছ-প্রজাপতি এসব বানিয়ে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দেওয়ালে ঝোলানো হত। বড় অপূর্ব ছিল এই গৃহসজ্জা! সমস্তটা জুড়ে থাকত গৃহিনীর শৈল্পিক মন। আর তাতে থাকত সেই মানবীর মনের কোণে সযত্নে লালিত জাগতিক বন্ধন, যত্ন আর সাংসারিক ভালবাসার গন্ধ ।
লেখক সেই অপূর্ব স্মৃতিটুকু বড় যত্ন করে তুলে রাখলেন নিজের কাছে। মায়ের অতুলনীয় ভালবাসা যেন মাখামাখি হয়ে রয়ে গেল তার বইয়ের প্রচ্ছদে। প্রচ্ছদটা বড্ড ভাল লাগলো সেই কারণে।
উৎসর্গপত্রে লেখা আছে আমাদের উত্তর-পূর্বের তিনজন স্বনামধন্য গল্পকারের নাম। এই উৎসর্গপত্র বারকোশকে একটা আলাদা মাত্রা দিলো। ভূমিকা লিখেছেন যিনি তাঁর গল্প পড়ে আমরা লেখার জগতে পা রেখেছি। এদিক দিয়ে বইটা বিখ্যাত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থের আশিস-ধন্য।
মোট পনেরোটি গল্প আছে এই সংকলনে। গল্প ধরে ধরে কিছু বলব না। বইটা শেষ করে পাশে মুড়ে রেখেছি। মাথার ভেতর কিছু নাম ঘাই মারছে। অনসূয়া দেবী, শৈলবালা দেবী, সোহাগ, মণিকুন্তলা, অম্বিকাচরণ, বিশ্বেশ্বর, কল্যাণী… এদের নিয়েই গল্প লিখেছেন লেখক। এই নামগুলো কিন্তু এই সময়ের নয়। এরা সবাই আমাদের ফেলে আসা সময়কে বহন করছেন। এখানেই একটা ম্যাজিক হয়ে গিয়েছে। যে দিনগুলো আমাদের চলে গেছে,যে দিনগুলোর কথা ভাবলে আজও বুকের ভেতর হুহ করে… রূপরাজ তাঁর বলিষ্ঠ কলম দিয়ে আলগোছে সেই জায়গাটা ছুঁয়ে দিলেন। আর সেটা এই সময়ে দাঁড়িয়ে! আর তাই বারকোশ আয়েস্তা রিফু মান্দাস বড্ড ছুঁয়ে গেল। এ আমাদের চলে যাওয়া সোনালি দিনের কথকতা। বিশেষ করে বারকোশ গল্পটা একটা মাস্টারপিস হয়ে থাকবে।
বাকি গল্পগুলোর কথাও একটুখানি বলে রাখি। মনে হলো, প্রত্যেকটা গল্পে গল্পকার পুরনো বুনোট ভেঙে আবার নতুন করে সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেকটা গল্পই তাই ভিন্ন-ভিন্ন স্বাদের, ভিন্ন ধরনের।
কিছু গল্পে বর্তমান সময়ের রূঢ় বাস্তব অত্যন্ত সুচারু ভাবে ফুটে উঠেছে। ‘অন্য আমি’ গল্পটা এক কথায় অসাধারণ। এটা পড়ার পর একটা ঘোর লেগে যায়। এ নিয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। এটা একান্তই এক অনুভবের ব্যাপার।
‘দহন মুক্তির কথকতা’ এক অন্য ধরনের প্রচেষ্টা। সম্পূর্ণ গল্প জুড়ে টেলিফোনে কথাবার্তা। এই ধরণের একটা গল্প পড়েছিলাম, বিখ্যাত লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা । সম্পূর্ণ গল্প জুড়ে মাত্র দুটি চরিত্র ছিল। তবে ওরা মুখোমুখি বসে কথা বলেছিল। রূপরাজ ভট্টাচার্যের এই ভাবনা গল্পের নতুন ভূমি তৈরি করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
সবশেষে বলবো মানুষ রূপরাজ ভট্টাচার্য আর লেখক রূপরাজ ভট্টাচার্য দুটি আলাদা সত্ত্বা। আমার অন্তত বইটা পড়ে এমনটাই মনে হলো। সব মানুষের ভেতর বাড়িতে বসত করেন অন্য একজন। তাকে সব সময় দেখা যায় না, ধরা যায় না। পরিবেশ-পরিস্থিতি-স্থান- কাল-পাত্র বিচার করে তিনি আড়ালে থেকে যান। কিন্তু অলক্ষ্য থেকে সব কিছু দেখেন, বিচার করেন। ব্যক্তিগতভাবে লেখক রূপরাজ ভট্টাচার্যকে চিনি। কিন্তু গল্পের চরিত্ররা যে মনোভূমি থেকে উঠে এসেছেন সে সব যেন সেই অধরা রূপরাজ ভট্টাচার্যের সৃষ্টি। ভেতর বাড়ির মানুষটি নিজের জমিয়ে রাখা সব দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা- অবহেলা কলমের আঁচড়ে নিখুঁত ভাবে তুলে দিয়েছেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের মুখে। তাই জীবন্ত হয়ে উঠেছে গল্পেরা। একরাশ ভাললাগা অনুভব করলাম বইয়ের শেষ পাতাটা বন্ধ করার পর!
লেখকের কলম নিরন্তর চলুক,এই কামনা রইলো।
কবিতা----------
নীল ভালবাসা
কিরণ
শঙ্খনীল হয়েছে হৃদয়
তোমার উপচে পড়া ভালবাসা নামক অবহেলা, উপেক্ষা,ক্লিষ্টতা আর অপরিমেয় সন্দেহের মোড়কে।
অনেকদিন হলো –
চোখে রাখা হয়নি চোখ, কাঁধে মাথা
কিংবা ওই উষ্ণ হাতে হাত।
অথচ নিয়মমাফিক
রাতে ভিজি দু'জনে।
পরিপাট্য লাল সংসারের মোড়কে
শুভ্র ভালবাসারা পথের পাশে ধুঁকছে
শুধু একটু লালন,বোঝাপড়া আর সময়ের কার্পণ্যতায়।